রুই মাছের বাহ্যিক গঠনঃ রুই (Labeo rohita) একটি অস্থিময় মাছ। এর দেহ অনেকটা মাকু আকৃতির অর্থাৎ মধ্যভাগ চওড়া ও দুই প্রান্ত ক্রমশ সরু। প্রস্থ অপেক্ষা উচ্চতা বেশি, প্রস্থচ্ছেদ ডিম্বাকার। রুই মাছ চলনের সময় পানির ভিতর গতি বাধাপ্রাপ্ত হয় না, তাই এ ধরনের আকৃতিকে স্ট্রিমলাইন্ড (streamlined) বলে। একটি রুই মাছ সর্বোচ্চ ২০০ সে.মি. পর্যন্ত লম্বা হতে পারে, সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে এবং ওজন সাধারণত ৪৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে বলে জানা গেছে। রুই মাছের দেহ তিন অংশে বিভক্ত, যথা-
ক. মাথা (Head):
এই মাছের দেহের অগ্রপ্রান্ত থেকে কানকোর পশ্চাৎপ্রান্ত পর্যন্ত অংশটি মাথা, যা ৪-৫ ইঞ্চি লম্বা ও পৃষ্ঠভাগ উত্তল কিন্তু উদর থেকে মস্তকের উপরিভাগ বেশি উত্তল।তুণ্ড (snout) হচ্ছে নাক, মুখ এবং চোয়াল সমন্বিত মুখের বর্ধিত অংশ, এটি ভোঁতা, নিচু, কিন্তু চোয়ালের সামনে বাড়ানো এবং কোনো পার্শ্বীয় খণ্ডবিহীন। এই মাছের রয়েছে অর্ধচন্দ্রাকার মুখ, যা নিচের দিকে উপপ্রান্তীয়ভাবে অবস্থিত ও মোটা ঝালরের মতো ঊর্ধ্ব, আড়াআড়ি বিস্তৃত ও নিম্নোষ্ঠ আবৃত। এর ঊর্ধ্বচোয়ালের পিঠের দিকে একজোড়া নরম ও ছোট ম্যাক্সিলারি বার্বেল (maxillary barbels) রয়েছে। মাছের তুণ্ডের পৃষ্ঠদেশে দুচোখের একটু সামনে রয়েছে একজোড়া নাসারন্ধ্র (nostrils)। এদের প্রত্যেক নাসারন্ধ্রের পেছনে এবং মাথার দুপাশে একটি করে বড় গোল চোখ রয়েছে। চোখে পাতা থাকে না, কিন্তু কর্ণিয়া স্বচ্ছ ত্বকীয় আবরণে আবৃত। এর মাথা আঁইশবিহীন দেহকাণ্ড ও লেজ মিউকাসময় সাইক্লয়েড (cycloid) আঁইশে আবৃত।
মুখ: এই মাছের মুখ নিচের দিকে অবস্থিত, মুখের দুই কোনা পিছনের দিকে বাঁকা হওয়াতে মুখ অর্ধচন্দ্রাকার এবং থুঁতনি ভোঁতা, নিচু, কদাচিৎ স্ফীত। মুখের নিচে ও উপরে ঝালরের মত ঠোঁট আছে। থুঁতনির পৃষ্ঠদেশের চোখের সামান্য সম্মুখে একজোড়া নাসারন্ধ্র আছে।
চোখ: মাথার দুই পাশে ১ টি করে মোট ২ টি বড় বড় চোখ আছে। চোখে কোন পাতা নেই, কর্নিয়া স্বচ্ছ চামড়ার আবরণ দ্বারা আবৃত।
খ. দেহকান্ড (Trunk):
কানকোর শেষ ভাগ থেকে পায়ু পর্যন্ত দেহের মধ্য অংশটি দেহকাণ্ড। এ অংশটি চওড়া এবং বিভিন্ন ধরনের পাখনা (fin) বহন করে। পাখনাগুলো পূর্ণ বিকশিত এবং অস্থিময় পাখনা-রশ্মি (fin rays) যুক্ত। দেহকান্ডের পশ্চাৎপ্রান্তের অঙ্কীয় দিকে ঠিক মাঝ বরাবর তিনটি ছোট ছিদ্র থাকে: প্রথমে পায়ুছিদ্র, মাঝে জননছিদ্র এবং সবশেষে রেচনছিদ্র।
রুই মাছের পাখনাসমূহ (Fins):
মাছের চলনাঙ্গকে পাখনা বলে। পাখনা সাধারণত চাপা ও পাখনা-রশ্মিযুক্ত। পাখনার ভিতরে অবস্থিত সমান্তরালভাবে সজ্জিত সূক্ষ্ম শলাকার অস্তঃকঙ্কালকে পাখনা রশ্মি (fin rays) বলে। রুই মাছে মোট পাঁচ ধরনের পাখনা দেখা যায়-
পৃষ্ঠপাখনা (Dorsal fin) : এই মাছের দেহকাণ্ডের মাঝ বরাবরের পিছনে বড়, কিছুটা রম্বস আকারের একটি মাত্র পৃষ্ঠ পাখনা রয়েছে । এর উপরের দিকের মধ্যভাগ অবতল এবং এখানে ১৪-১৬টি পাখনা-রশ্মি থাকে।
বক্ষ-পাখনা (Pectoral fin) : কানকোর ঠিক পেছনে দেহকান্ডের সম্মুখ পার্শ্বদিকে একজোড়া বক্ষ-পাখনা আছে। এবং প্রত্যেক পাখনাতে ১৭-১৮টি পাখনা রশ্নিযুক্ত থাকে।
শ্রোণি-পাখনা (Pelvic fin) : বক্ষপাখনার সামান্য পেছনে একজোড়া শ্রোণি পাখনা অবস্থিত এবং এটি ৯টি করে পাখনা-রশ্মিযুক্ত।
পায়ু-পাখনা (Anal fin) : পায়ুর ঠিক পিছনে দেহের অঙ্কীয়দেশের মধ্যরেখা বরাবর একটি পায়ু-পাখনা থাকে। এটি ৬-৭টি পাখনা-রশ্মিযুক্ত।
পুচ্ছপাখনা (Caudal fin) : লেজের পশ্চাতে অবস্থিত পাখনাটি পুচ্ছ-পাখনা। এতে আছে ১৯টি পাখনা-রশ্মি। পুচ্ছ-পাখনা রুই মাছের চলাচলে এবং অন্যান্য পাখনা দেহের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করে। দেহের দু’পাশে এক সারি ছোট গর্ত আছে যা আঁইশের নিচে অবস্থিত একটি লম্বা খাদের সঙ্গে যুক্ত। এ খাদ ও গর্তের সমন্বয়ে মাছের পার্শ্বরেখা অঙ্গ (lateral line organ) গঠিত হয়। এতে অবস্থিত সংবেদী কোষ পানির তরঙ্গ থেকে পানির গুণাগুণ সংক্রান্ত রাসায়নিক সংবেদ গ্রহণ করে।
গ. লেজ (Tail) :
পায়ুর পরবর্তী অংশটি লেজ। এর শীর্ষে রয়েছে হোমোসার্কাল (homocercal) ধরনের পুচ্ছ-পাখনা। এটি উল্লম্বতলে (vertical plane) প্রসারিত এবং পিছনে, উপরে ও নিচে দুটি প্রতিসম বাহ্যিক খণ্ডে বিভক্ত। ডার্মাল রশ্মিগুলো উপরে ও নিচের খণ্ডে বড়, মাঝখানে ছোট।
রুই মাছের আঁইশের বৈশিষ্ট্য (Scales):
• রুই মাছের দেহকাণ্ড ও লেজ মিউকাসময়
• সাইক্লয়েড (cycloid) ধরনের (কারণ গোলাকৃতি) আঁইশ দ্বারা আবৃত।
• আঁইশ পাতলা, প্রায় গোল ও রূপালি চকচকে হয়ে থাকে।
• পৃষ্ঠদেশীয় আঁইশের কেন্দ্র লালচে প্রান্ত কালো রংয়ের হয় এবং কেন্দ্রটি লালচে রং জনন ঋতুতে আরও গাঢ় ও উজ্জ্বল হয়। এছাড়াও জলচর উদ্ভিদসমৃদ্ধ পরিবেশের এর পৃষ্ঠদেশের রং লালচে-সবুজ হতে পারে।
• এখানে আঁইশে এককেন্দ্রিক বৃত্তাকার স্তরে স্তরে অস্থি-উপাদান জমা হওয়ার কারণে আঁইশের উপরের অংশে বৃত্তাকার উঁচু আল ও নিচু খাদ সৃষ্টি হয়। এই স্তরগুলোর কেন্দ্রটিকে ফোকাস (focus) বলে। এটি সাধারণত একপাশে থাকে।
• উঁচু আলগুলোকে সার্কুলাস (বহুবচনে সার্কুলি) বা বৃদ্ধিরেখা বলে। এগুলোর সাহায্যে বাৎসরিক বৃদ্ধির এবং বিভিন্ন ঋতুতে বৃদ্ধি সম্বন্ধে প্রকৃত ধারণা পাওয়া যায়।
• রুই মাছের আঁইশের বৃদ্ধি সাধারণত বসন্তকালে ও গ্রীষ্মে বেশি হয়।
• আঁইশের সম্মুখভাগ তন্তুময় যোজক টিস্যু-নির্মিত এবং ডার্মিসের পকেটের মধ্যে প্রবিষ্ট থাকে। পশ্চাৎভাগ ডেন্টিন- নির্মিত ও উন্মুক্ত।
• স্পষ্ট বৃদ্ধিরেখা ও অনেক রঞ্জক কোষ এই উন্মুক্ত অংশে থাকে। এছাড়া এই আঁইশগুলো পরস্পরকে আংশিক ঢেকে লম্বালম্বি ও কোণাকুণি সারিতে বিন্যস্ত থাকে।
• আঁইশগুলো সবসময় মিউকাসের পাতলা পিচ্ছিল আস্তরণ দিয়ে আবৃত থাকে। এবং এর মাথার দুই পাশে ৪ জোড়া ফুলকা রয়েছে
Read more